ভাষা শিখন ও ভাষার আত্তীকরণ

ভাষা শিখন ও আত্তীকরণ

ভাষা শিখন ও আত্তীকরণ

ভাষা শিখন ও আত্তীকরণ

শিখন হলো  একটি প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, চর্চা বা শেখার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান, দক্ষতা বা আচরণ অর্জন করে।

বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী শিখনের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন যেগুলি নিচে দেওয়া হল- 
নোয়াম চমস্কি – “শিখন হলো মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্ষমতা যার  মাধ্যমে শিশু নতুন ভাষা বা জ্ঞান অর্জন করে।”

বি. এফ. স্কিনার – “শিখন হলো পুরস্কার ও শাস্তির মাধ্যমে আচরণ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।”

জন ডিউই – “শিখন হলো অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান শেখা।”

থর্নডাইক – “শিখন হলো চেষ্টা ও ভুলের (Trial and Error) মাধ্যমে সঠিক কাজ শেখা।”

ব্যান্ডুরা – “শিখন হলো অন্যকে দেখে শেখা, অনুকরণ করা বা অনুসরণ করা।”

পিয়াজে – “শিখন হলো বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের অংশ, যা শিশুদের চিন্তাধারা গঠনে সাহায্য করে।”

ভাইগটস্কি – “শিখন হলো সমাজ ও আশপাশের মানুষের সহায়তায় নতুন কিছু শেখা।”

১. LAD (Language Acquisition Device)

২. LAS (Language Acquisition System

নোয়াম চমস্কি মনে করেন, মানুষের মস্তিষ্কে জন্মগতভাবে একটি বিশেষ প্রক্রিয়া রয়েছে, যা ভাষা শেখার ক্ষমতা প্রদান করে। তিনি এই ধারণাটিকে “Language Acquisition Device (LAD)” নামে অভিহিত করেছেন। 

ক.এটি মানুষের মস্তিষ্কে জন্মগতভাবে উপস্থিত থাকে।

খ.শিশুরা স্বাভাবিকভাবে ভাষা শিখতে পারে, শুধুমাত্র পরিবেশ থেকে শব্দ শুনেই।

গ.ব্যাকরণের জটিল নিয়ম শিশুরা স্বাভাবিকভাবে আয়ত্ত করতে পারে, যা শুধুমাত্র অনুকরণ (Imitation) দ্বারা সম্ভব নয়।

ঘ. এটি “Universal Grammar” বা সার্বজনীন ব্যাকরণ ধারণার সঙ্গে যুক্ত।

ভাষা শিখন ও আত্তীকরণ


যদিও চমস্কি মূলত LAD-এর ধারণা দেন, পরবর্তীতে ভাষা অর্জনের ক্ষেত্রে পরিবেশ ও সামাজিক যোগাযোগের ভূমিকা বোঝাতে LAS (Language Acquisition Support) ধারণাটি বিকশিত হয়।

১. শিশুর ভাষা শেখার জন্য পরিবার, সমাজ ও শিক্ষকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

২. ভাষার বিকাশের জন্য পারিপার্শ্বিক উৎসাহ ও অনুশীলন প্রয়োজন।

৩. এটি মূলত মনোবিজ্ঞানী জেরোম ব্রুনার-এর LASS (Language Acquisition Support System) তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত।

নোয়াম চমস্কি UG এর ধারণা দেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের মস্তিষ্ক জন্মগতভাবেই ভাষা শেখার ক্ষমতা নিয়ে আসে এবং সব ভাষার কিছু সাধারণ নিয়ম থাকে, যা শিশুরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিখতে পারে।

ভাষা শিখন ও আত্তীকরণ

  • জন্মগত ভাষা শেখার ক্ষমতা – মানুষের মস্তিষ্কে জন্মগতভাবে ভাষা শেখার জন্য একটি কাঠামো (structure) থাকে, যাকে চমস্কি LAD (Language Acquisition Device) বলেছেন।
  • শব্দগুলি ক্রমানুসারে সাজানো থাকে যাতে একটি সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক বজায় থাকে।
  • শিশুরা ছোটবেলায় যে ভাষাই শিখুক না কেন, তারা সহজেই ব্যাকরণগত নিয়ম বুঝে নেয়।
  • শুধু অনুকরণ নয় – শিশু শুধু শোনা বা অনুকরণ করে ভাষা শেখে না, বরং মস্তিষ্কে থাকা জন্মগত নিয়ম অনুযায়ী ভাষা আয়ত্ত করে।
  • নতুন বাক্য গঠন ক্ষমতা – শিশুরা এমন অনেক বাক্য বলতে পারে, যা তারা আগে কখনো শোনেনি। এটি প্রমাণ করে যে ভাষা শেখা শুধুমাত্র অনুকরণের মাধ্যমে হয় না, বরং মস্তিষ্কের ভেতরেই ভাষার কাঠামো বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে।

অধ্যাপক পবিত্র সরকার তার প্রবন্ধে Jean Aitchisan এর  The articulate Manual গ্রন্থ থেকে শিশুর ভাষা শিক্ষার প্রথম পর্যায়ে নিয়ে বিশেষ আলোচনা করেছেন শিশুর কোন ভাষা কোন বয়সে শেখে তার একটি তালিকা দেয়া হলো: 

ভাষা পর্যায়শুরু হওয়ার বয়স 
কান্নাজন্মকাল
কু কু (Cooing)ছয় সপ্তাহ বা ৪২ দিন 
কলধ্বনি (Babbling)ছয় মাস 
কথার সুর Intonation Patternsআট মাস 
এক -শব্দ পর্বএক বছর, এই এক শব্দ পর্বই শিশুর ভাষা বিকাশের বা ভাষা প্রকাশের প্রথম ধাপ।
দুই- শব্দ পর্বদেড় বছর
পদ নির্মাণদু-‘বছর
প্রশ্ন, নিষেধ বাক্যসওয়া দুবছর
জটিল বাক্যপাঁচ বছর
পরিণত ভাষা দক্ষতাদশ বছর

  নোট- এই তালিকাটি রিতা বুক এজেন্সি থেকে নেওয়া।

ভাষা শিখন ও আত্তীকরণ

  • Telegraphic Speech– দুই আর তিন শব্দ পর্ব কে Telegraphic speech বলে।
  • টেলিগ্রাফিক স্পিচে শব্দগুলো ঠিকমতো সাজানো থাকে না।
  • শিশু, শব্দের মধ্যে বিভক্তি, প্রত্যয় যোগ করা শুরু করে প্রায় দু বছর বয়সে। 
  • প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিশুদের আগে ভাষা শেখানো উচিত, তারপর বর্ণমালা। কারণ শিশুরা ভাষা আগে শেখে, তারপর লেখার জন্য বর্ণমালা ব্যবহার করতে শিখে

প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিশুদের আগে ভাষা শেখানো হয়, তারপর বর্ণমালা। কারণ শিশুরা ভাষা আগে শেখে, তারপর সে লেখার জন্য বর্ণমালা ব্যবহার করতে শিখে।

  • যখন শিশুর কিছু শব্দ ও বাক্য সম্পর্কে ধারণা জন্মে, তখন তাকে ধীরে ধীরে বর্ণমালা শেখাতে হবে।
  •  সহজ বর্ণ দিয়ে প্রথমে শুরু করতে হবে।
  •  প্রথমে অক্ষর চিনবে তারপর লিখতে শিখবে

১. সহজ শব্দ শেখানো (মা, বাবা )

২. ছোট বাক্য শেখানো (আমি খাব, আমি যাব)

৩.  গল্প, ছড়া, গান শেখানো ( যাতে ভাষার প্রতি আগ্রহ বাড়ে)

৪.  এরপর বর্ণমালা চেনানো (অক্ষর ও তাদের উচ্চারণ শেখানো)

৫.লেখার অভ্যাস গড়া।

>মাতৃভাষার এবং ইংরেজি ভাষার সংস্কার চিরদিনই পাশাপাশি বিরুদ্ধে হইয়া বাস করিবে একটা আর একটাকে আত্মসাৎ করিয়া লইবে না এই জন্যই পর ভাষা শেখা এবং তাহাকে ব্যবহার করা এত দুঃখ। (শান্তিনিকেতন পত্রিকা, বৈশাখ 1326 (1919), রীতা বুক এজেন্সি)

>আমরা যখন মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষা শিখি তখন সেই ভাষা আমাদের সচেতন ভাবে চেষ্টার মাধ্যমে শিখতে হয় । এই জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য ভাষা শেখা কে দুঃখ বলেছেন।

ভাষা শিখন ও আত্তীকরণ

>রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে শুরুতে শিক্ষার ভিত মজবুত করতে ভালো অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছে ভাষা শিখতে হবে। 

বর্ণক্রম পদ্ধতি হলো ভাষা শিক্ষার একটি পদ্ধতি যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রথমে বর্ণমালা (প্রথমে স্বরবর্ণ ও পরে ব্যঞ্জনবর্ণ) শেখানো হয়, তারপর শব্দ গঠন ও বাক্য গঠন শেখানো হয়। এটি সাধারণত প্রাথমিক স্তরে শিশুদের ভাষা শেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।

শব্দক্রম পদ্ধতি হলো ভাষা শিক্ষার একটি পদ্ধতি যেখানে শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ শব্দ (Word) শেখানো হয়, তারপর ধীরে ধীরে বাক্য গঠন শেখানো হয়। এটি বর্ণক্রম পদ্ধতির বিপরীত, কারণ এখানে প্রথমে বর্ণ শেখানো হয় না, বরং পুরো শব্দ শেখানো হয়।

বাক্যক্রম পদ্ধতি হলো ভাষা শিক্ষার একটি পদ্ধতি যেখানে শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ বাক্য (Sentence) শেখানো হয়, তারপর ধীরে ধীরে শব্দ ও বর্ণ শেখানো হয়। এটি বর্ণক্রম ও শব্দক্রম পদ্ধতির বিপরীত, কারণ এখানে প্রথমে পুরো বাক্য শেখানো হয়, তারপর শব্দ ও বর্ণ বিশ্লেষণ করা হয়।

ধ্বনিসাম্য পদ্ধতি বলতে বোঝায় যে শব্দগুলো ব্যবহার করবে সে শব্দগুলোর মধ্যে উচ্চারণ একই রকমের হবে। যেমন কর খর জড় সর ইত্যাদি। 

গল্প বলা পদ্ধতিতে কোনো ঘটনা বা কাহিনি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয় যাতে শ্রোতারা আগ্রহী হয়। এই পদ্ধতিতে—

  • কণ্ঠস্বরের ওঠানামা, আবেগ ও নাটকীয়তা ব্যবহার করা হয়।
  • শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হাতের ইশারা বা মুখের অভিব্যক্তি ব্যবহার করা হয়।
  • বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা বা কল্পিত কাহিনি বলা হয়।

শিশুদের পড়াশোনা ও নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য কার্যকর পদ্ধতি।

ভাষা শিখন ও আত্তীকরণ

যখন কোন কবিতা সঠিক ছন্দ, লয়, আবেগ,‌স্পষ্ট উচ্চারণ সহযোগে প্রকাশ করা হয় তখনই সেটা হয় আবৃত্তি।

  • আবৃত্তির সময় উচ্চারণ স্পষ্ট ও শ্রুতিমধুর হতে হয়।
  • সঠিক উচ্চারণ, ছন্দ ইত্যাদি লক্ষ্য রাখতে হবে।

>ব্যাকরণ শিক্ষা আরোহী পদ্ধতিতে দিতে হবে। প্রথমে উদাহরণ তারপর সূত্রতে আসতে হবে।

>শিক্ষার্থীদের প্রথমে সরব পাঠে উৎসাহ দিতে হবে যাতে তাদের সঠিক উচ্চারণ, যতিচিহ্ণ  প্রভৃতি বিষয়ে তাদের সম্যক ধারণা জন্মে।

To get all bengali pedagogy notes click here.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Copying content is prohibited